যশোর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও নামকরণের ইতিহাস
এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক আলোচনায় ড. মোহাম্মদ মুহিবউলস্নাহ ছিদ্দিকী ‘যসোরের ইতিহাস প্রসঙ্গ’ বইয়ের অংশ বিশেষ তুলে ধরা যায়। কারণ এই মতটি যথেষ্ট ঐতিহাসিক দলিলের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে প্রতীয়মান হয়। লেখকের মতে যশোর জেলার নামকরণের সর্বপ্রথম ব্যাখ্যা প্রদানকারী হলেন হরিশচন্দ্র তর্কালঙ্কার; যিনি মনে করেন, বাংলার দীর্ঘদিনের রাজধানী গৌড়ের যশ হরণ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে এ নতুন রাজ্যের নামকরণ হয়েছিল ‘জসর রাজ্য’। কিন্তু তর্কালঙ্কার তার এ চমৎকার ব্যাখ্যা ও বক্তব্যের উৎস সম্পর্কে কোন তথ্য প্রদান করেননি বলে জনাব ছিদ্দিকী মনে করেন। তিনি বলেন, ‘‘ ‘রম্নচিরারম্নচিহরে’ শব্দের অর্থ সৌন্দর্যহরণকারী অর্থাৎ ইহার সাথে সুন্দর বস্ত্তসমূহের তুলনা করলে ইহার নিকট তাদের কোন সৌন্দর্য থাকে না।’’ তার বিবেচনায় এর অর্থ ‘সর্বাপেক্ষা যশস্বী’। ওয়েষ্টল্যান্ডের এ ব্যাখ্যার সত্যতা প্রমাণের জন্য রাজা সীতারাম রায় প্রতিষ্ঠিত কানাইনগর মন্দির গাত্রের এক ফুট পরিসর বিশিষ্ট কষ্টি পাথরের গোলাকার প্রসত্মরে উৎকীর্ণ শেস্নাকটি নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো।
‘‘বাণ- দ্বন্ধাঈচান্দ্রৈঃ পরিগণিত-শকে কৃষ্ণতোষাভিলাষঃ
শ্রীমন্দিশ্বসখাসোদ্ভ বকুল কমলোদ্ভাসকো ভানুতুল্যঃ।
ভ্রাজচ্ছিলৌঘযুক্তং রম্নচিররম্নচি হরেকৃষ্ণগেহং বিচিত্রং
শ্রীসীতারামরায়ো যদুপতি নগরে ভক্তিমানুৎসর্সজ্ঞ’’।
বাংলা হরফে লিখিত সংস্কৃত ভাষায় প্রণীত এ শেস্নাকটি অনুবাদ করতে গিয়ে সতীশমিত্র লিখেছেন- ‘‘বাণ=৫, দ্বন্ধ=২,অঈ=৬, চন্দ্র=১, অঙ্কের বিপরীতক্রমে ১৬২৫ শক বা ১৭০৩ খ্রীস্টাব্দ পাওয়া যায়। ‘কৃষ্ণতোষাভিলাষঃ’ সীতারামেরই বিশেষণ। এ স্থলে শ্রীকৃষ্ণের তুষ্টির জন্য অথবা গুরম্নদেব কৃষ্ণবলস্নভের তুষ্টির জন্য, এই উভয় অর্থই প্রচ্ছন্ন আছে। সীতারাম রায়ের পূর্ব পুরম্নষের উপাধি ছিল ‘বিশ্বাসখাস’, সে কথা পূর্বে বলিয়াছি, তিনি জন্মলাভে সেই বংশ উজ্জ্বল করিয়াছিলেন। শেস্নাকটির সরলার্থ এইঃ সূর্যের মত যিনি বিশ্বাস-খাস-কুল-কলমকে প্রস্ফুটিত করিয়াছিলেন, সেই ভক্তিমান শ্রীসীতারাম রায় স্বীয় গুরম্নদেব কৃষ্ণবলস্নভের তুষ্টির নিমিত্ত ১৬২৫ শকে যদুপতি (কানাই) নগরে সমুজ্জ্বল-শিল্পরাজি সমন্বিত সুরম্নচিসম্পন্ন বিচিত্র হরেকৃষ্ণ মন্দিরটি উৎসর্গ করেন’’।
সীতারাম রায়ের কানাইনগরে মন্দিরগাত্রের শিলালিপির সর্বপ্রথম বিকৃত পাঠ আমাদের কাছে পৌঁছে ওয়েষ্টল্যান্ডের মাধ্যমে। তিনি ‘রম্নচির রম্নচি হরে’ শেস্নাকের এ অংশকে যদুপতি নগরের বিশেষণ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং ‘বহু কষ্ট কল্পনা’ করে ‘রম্নচির রম্নচি হরে’ অংশের অর্থ করেছেন ‘সৌন্দর্যহরণকারী’। অথচ এটা সকলের জানা যে এ বিগ্রহের জন্য উৎসৃষ্ট গ্রামের নাম হরেকৃষ্ণুর ‘রম্নচির রম্নচি’ শব্দটি ‘হরেকৃষ্ণগেহং’ পদের-বিশেষণ। এখানে ‘রম্নচি’ শব্দ দ্বারা স্থাপত্যে কৌশল বা পদ্ধতির রম্নচির কথা বলা হয়েছে অর্থাৎ মন্দিরটি রম্নচিসম্মত স্থাপত্যে নির্মিত।
উপরের আলোচনা হতে এটা সহজে প্রতীয়মান হয় যে ওয়েষ্টল্যান্ড দেশীয় ভাষা ও শব্দের সঠিক অর্থ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়ে বিকৃত পাঠ উপস্থাপন করেছেন অথবা জসরের জেলা কালেক্টর হিসেবে পাঠ গ্রহণের জন্য এমন লোক প্রেরণ করেছিলেন যিনি সঠিকভাবে পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হননি। দ্বিতীয়ত, যদি আমরা ধরে নেই যে ওয়েষ্টল্যান্ডের পাঠ সঠিক। তাহলে প্রশ্ন আসে যদুপতিনগর বা কানাইনগরের বিশেষণের মাঝে জসরের নামকরণের ব্যাখ্যা নিহিত থাকে কি করে? রাজা সীতারাম রায়ের আমলে নিশ্চয় যদুপতিনগর বা কানাইনগর এবং জসর সমার্থক ছিল না। তৃতীয়ত, তিনি ‘রম্নচির রম্নচি হরে’ শব্দের অর্থ করেছেন ‘সৌন্দর্য্যহরণকারী’ এবং তার উপর ভিত্তি করে তিনি জসর নামের ব্যাখ্যা দিয়েছেন ‘সবর্বাপেক্ষা যশস্বী’। সাধারণ বাঙালি জানেন যে হরেকৃষ্ণ হিন্দু দেবতা বা বিগ্রহের নাম। হরে শব্দের অর্থ করেছেন হরণকারী এবং সেখানে খুঁজে পেয়েছেন জসর নামের অর্থ। অবশ্য তিনি নিজেই এ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন বলে দাবি করেছেন। তাই ঐতিহাসিক উৎস বিহীন অতিপান্ডিত্যপূর্ণ এ ব্যাখ্য বিভ্রামিত্মকর এবং বিকৃতপাঠের উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি যেমন তর্কালঙ্কারের ব্যাখ্যাকে ‘কিছু কষ্ট কল্পনা’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন ঠিক তেমনি সতীশচন্দ্র মিত্রের সাথে আমরাও ওয়েষ্টল্যান্ডের ব্যাখ্যাকে ‘বহু কষ্ট কল্পনা’ বলে বাতিল করতে পারি।
যশোর জেলার নামকরণ সম্পর্কিত আরেকটি ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন প্রখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ আলেকজেন্ডার কার্ণিংহাম। তিনি লিখেছেন-‘যশোর’ শব্দটি আরবী ভাষায় ‘জসর’ শব্দের রূপামত্মরিত রূপ। আরবী ‘জসর’ শব্দের বাংলা অর্থ হলো-সেতু বা সাঁকো। সমগ্র জসর অঞ্চলে মুসলিম অভিযানের প্রাক্কালে অসংখ্য খাল-বিল-নদ-নদী থাকার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য ঐ সকল নদ-নদীর উপর সেতু বা সাঁকোর প্রয়োজন ও ব্যবহার ছিল। অসংখ্য সাঁকো ও সেতুর ব্যবহার থাকার কারণে নবাগত মুসলমানেরা এতদাঞ্চলকে ‘জসর’ বলে অভিহিত করে। সেই ‘জসর’ শব্দ পরিবর্তিত হয়ে জসর-যশর-যশোর- যশোহর হয়েছে। জসর জেলার নামকরণ নিয়ে আরও অনেকে আলোচনা করেছেন। তাদের মধ্যে ডাবিস্নউ. ডাবিস্নউ. হাণ্টার, ওমালী, হীরালাল ভট্রাচার্য, লতিফুল বারী প্রমুখের নাম উলেখযোগ্য। তবে তারা নতুন কোন মত বা ব্যাখ্যা প্রদান করেননি। বরং তারা তর্কালঙ্কার, ওয়েষ্টল্যান্ড এবং কার্ণিংহামের মতামতগুলো উদ্ধৃত করে জসরের নামকরণ বিশেস্নষণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। তাই নিজস্ব মতামত না থাকার কারণে তাদের আলোচনা পুনঃউপস্থাপন অপ্রয়োজনীয়।
জসরের প্রশাসনিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলার সুলতানী আমলে জসর কোন প্রশাসনিক একক ছিল না। হোসেনশাহী আমলে বাংলা ১৩টি আরশায় বিভক্ত ছিল, তখন জসর-খুলনা অঞ্চল আরশা খলিফতাবাদ ও ফতেহাবাদের মধ্যে অমত্মর্ভূক্ত ছিল। মোগল শাসনের প্রথম দিকে তারা বাংলাকে ১৯টি সরকারে বিভক্ত করে। কখনও জসর নামে পৃথক কোন সরকার ছিল না। এ এলাকা তখন সরকার খলিফতাবাদ, মুহাম্মদাবাদ এবং ফতেহাবাদের মধ্যে ছিল। মোগল অনুগত বিক্রমাদিত্য ‘জসর-রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার পর তার পুত্র প্রতাপাদিত্য বিদ্রোহী হলে মোগলেরা সে রাজ্য দখল করে নেয়। তখন হতে এ এলাকায় একজন মোগল ফৌজদার ছিল। মুর্শিদকুলী খানের আমলে প্রশাসনিক পুনঃবিন্যাস হলে বাংলার তেরটি চাকলার মধ্যে একটি হলো জসর। প্রশাসনিক ইতিহাসে জসর খুব বেশী প্রাচীন নাম নয়, বরং মুসলমানদের আগমনের পরে এ নাম প্রকাশিত হয় এবং মোগল আমলেই প্রশাসনিক একক হিসেবে স্বীকৃতি পায়। দ্বিতীয়ত, রাজশাহীতে যেমন পাহাড়পুর, বগুড়াতে যেমন মহাস্থানগড়, কুমিলার ময়নামতিতে যেমন শালবন বিহারের মতো প্রাচীন প্রত্নতত্ত্বের সন্ধান ঐ সকল স্থানের প্রাচীনত্ব প্রমাণ করে, জসর অঞ্চলে সে রকম কোন প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়নি যা ঐ স্থানের প্রাচীনত্বকে প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করে। তৃতীয়ত, ভৌগলিক ও ভূ-তাত্ত্বিক ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জসর অঞ্চল খুব বেশি পুরাতন নয়। চতুর্থত, প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রথম দিকে অংকিত মানচিত্রে জসর নামক কোন স্থানের কথা নেই। উদাহরণস্বরূপ-টলেমীর ম্যাপে জসর নামক কোন স্থানের অসিত্মত্ব নেই। শুধু তা নয় ১৬৫২ সনে এন স্যাউসন কর্তৃক অংকিত বাঙলার মানচিত্রে জসর নামের উলেস্নখ নেই। পঞ্চমত, বাংলার ইতিহাস প্রাচীন যুগের উপর আধুনিককালে প্রণীত গ্রন্থসমূহে জসর নামটি নেই। ষষ্ঠত, ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে মুসলমানেরা সাধারণত তাদের ধর্মীয় ভাষা আরবীতেই ব্যক্তি ও স্থানের নামকরণ করতো এবং এটাই তাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। পরবর্তীকালে ভারতে কোন কোন ক্ষেত্রে আরবীর সাথে ফার্সীর ব্যবহারও হয়েছে। বাংলায় ইসলাম প্রচারে সূফী-দরবেশদের ভূমিকাই মূখ্য। ব্যক্তি এবং স্থানের নামকরণ তাঁরা সাধারণত আরবীতেই করবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বাংলার মুসলমানদের নামকরণে আরবী ভাষার ব্যবহার একটি ঐতিহ্যগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরবীতে স্থানের নামকরণ কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, তবে সে ক্ষেত্রে স্থানের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য অথবা অন্য কোন প্রধান বৈশিষ্ট্য নামকরণকে প্রভাবিত করতে পারে এবং জসরের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে। সপ্তমতঃ মীর্জা নাথনের প্রণীত বাহারীস্থান-ই-গায়বী এবং আবুল ফজল প্রণীত আইন-ই-আকবরীতে আরবীতে লেখা ‘যসর’ শব্দটি উলেখ আছে। আইন-ই-আকবরীতে যশর বা জসর সরকার খলিফবাদের একটি মহাল হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু বাহারীস্থানে প্রতাপাদিত্যের পতন, সেখানে মোগল ফৌজদার নিয়োগ, ফৌজদারের মৃত্যু, নতুন ফৌজদার নিয়োগ, ফৌজদারের নৈতিকস্খলন, সংশোধনের সুযোগ প্রদান, ফৌজদারের বরখাসত্ম প্রভৃতি বিষয় বর্ণনা করতে গিয়ে মীর্জা নাথান যশর বা জসর শব্দটি বহুবার ব্যবহার করেছেন। উভয় সাঁকো অর্থে ‘জসর’ এবং স্থান অর্থে ‘জসর’ শব্দটির একই বানানে লিখেছেন, যার অর্থ সাঁকো বা সেতু। তাই আরবী ‘জসর’ শব্দ থেকে ‘যশর’ নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে মেনে নেয়া যায়।
উলেস্নখিত বিষয়সমূহ পর্যালোচনা করে আমরা সহজে বলতে পরি যে জসর জেলার নামকরণ প্রাচীন নয়, বরং মধ্যযুগের। মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস, বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস। তাই জসর নামকরণ আরবী ‘জসর’ শব্দ হতে উৎপত্তি হয়েছে বলে কার্নিংহাম যে ধারণা করেছেন তা সত্য হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। প্রকাশিত মতামতের মধ্যে কার্নিংহামের মতামত ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভূগোল, ভূতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, যুক্তি ইত্যাদির দৃষ্টিকোণ হতে অধিকতর গ্রহণযোগ্য। তাই আরবী ‘জসর’ শব্দ হতে আধুনিক জসর জেলার নামের উৎপত্তি হয়েছে বললে সম্ভবত ভুল হবে না।১৭
সতীশচন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ থেকে জানা যায়, সম্রাট আকবর দিলির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে দেখলেন যে সমগ্র ভারতবর্ষজুরে বিদ্রোহের শিখা জ্বলছে। এসকল বিদ্রোহ দমন করতে না পারলে দিলির মসনদ কেঁপে ওঠার সম্ভাবনাও প্রবল। তিনি যখন দিলিস্নর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন তখন সমগ্র বাংলায় কররাণী শাসন চলছিল। তৎকালীন কররাণী বংশের শাসক সুলেমান খাঁ আকবরের সাথে একটি সদ্ভাবমূলক চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন। তার পুত্র বায়োজিদ খাঁ পিতার মত বুদ্ধিসম্পন্ন শাসক হতে পারেননি। যার ফলে তার সাথে আমত্যগণের বিবাদ সৃষ্টি হয়। এরপর বায়োজিদ খাঁকে হত্যার মাধ্যমে হাঁসু খাঁ ক্ষমতায় আসলেও সুলেমান খাঁয়ের ছোট ছেলে দায়ুদ খাঁ সেনাপতি লোদী খাঁর সাহায্যে হাঁসু খাঁকে পরাসত্ম করে ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ ও ক্ষমতা গ্রহণ করেন। দায়ুদ রাজা হওয়ার পর নিজ নামে খুতবা ও মুদ্রার প্রচলন করেন। দায়ুদ পিতৃরাজ্য লাভ করে উশৃংখলতার স্রোতে গা-ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি যখন দেখলেন যে তার ১ লক্ষ৪০ হাজার পদাতিক, ৪০ হাজার অশ্বারোহী, ৩ হাজার তিনশত হসিত্ম ও ২০ হাজার বন্ধুক-কামান ও বহুশত রণতরী রয়েছে, তখন তিনি উদ্ধত হয়ে স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। মোঘলদের দেশ হতে বিতাড়িত করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু তার প্রধানমন্ত্রী দূঃদর্শী বিক্রমাদিত্যের পিতা বৃদ্ধ ভবানন্দ মোঘল শাসকদের বিক্রম ও রাষ্ট্রজয়ের সংবাদ জানতেন এবং তিনি বিক্রমাদিত্যকে এ বিষয়ে অবগত করেছিলেন। বিক্রমাদিত্য তার পিতার কথামত রাজা দাউদকে সতর্ক করেন। কিন্তু রাজা দাউদ তার একক বুদ্ধিতে পরিচালিত হতেন। তাছাড়া ভবানন্দ আরোও বুঝতে পেরেছিলেন যে আত্মকলহে লিপ্ত পাঠানেরা মোঘল শক্তির বিরম্নদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। তাই তিনি সপরিবারে গৌড় রাজ্য ত্যাগের পরিকল্পনা করেন। তিনি জানতেন যমুনার পূর্বপারে দক্ষিণবঙ্গে সমুদ্রকূল পর্যমত্ম এক বিস্তৃর্ণ ভূভাগ রয়েছে। এই ভূভাগ তৎকালীন সময় চাঁদ খাঁ মছন্দরী নামক এক ব্যক্তির জায়গীর ছিল। চাঁদ খাঁ নিঃসসত্মান অবস্থায় মৃত্যুমুখে পড়ায় তার কোন উত্তরাধিকারী ছিল না। ভবানন্দের কথামত বিক্রমাদিত্য তাই দাউদের কাছে এই অঞ্চল চাওয়া মাত্রই পেয়ে গেলেন এবং বলা বাহুল্য যে সঙ্গে সঙ্গে যশোহর রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হলো। আর সময়টি ছিল ১৫৭৪ খ্রিঃ।১৮
মোঘলরা হুগলী-ত্রিবেনীর সন্নিকটে যমুনাতে প্রবেশ করলেন এবং ধীরে ধীরে গৌড়ের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়লে দায়ুদ বুঝতে পারলেন যে ঔদ্ধত্যের ফল ফলেছে। কিন্তু তিনি পালাতে রাজী হলেন না। অবশেষে বাতল খাঁ নামক একজন আমীর তাকে মাদকসেবন করিয়ে অজ্ঞান অবস্থায় নৌপথে পালাতে সমর্থ হন। বিক্রমাদিত্য তখন রাজার ধন সম্পত্তি নৌকায় বোঝাই করে পিছন পিছন আসতে থাকেন। তিনি পিতা ভবনন্দ ও তার পরিবারকে আগেই যশোরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ধনসম্পদ নিয়ে পালানো দূরহ বিধায় দাউদ বিক্রমাদিত্যকে এই সম্পত্তি তার কাছে গচ্ছিত রাখতে বললেন এবং তাকে প্রতিজ্ঞা করালেন যে এই ধনসম্পদ যেন বিক্রমাদিত্য বঙ্গদেশ মোঘলদের নিকট হতে স্বাধীন করার জন্য ব্যয় করেন। বিক্রমাদিত্য নৌকাভরে সেই ধনসম্পদ নিয়ে যশোর চলে আসলেন। পরবর্তীতে দাউদ অনন্যোপায় হয়ে মোঘলদের বশ্যতা স্বীকার করলে তাকে উড়িষ্যার শাসনভার দেয়া হলো এবং মুনেম খাঁকে গৌড় রাজধানী করে বাংলা বিহারের কর্তৃত্ব প্রদান করা হলো। ইতিমধ্যে গৌড়ে এক মহামারি বিসত্মার লাভ করলে মুনেম খাঁ তাতে মারা যান। এখন আকবর খাঁ জাহানকে বাংলার শাসনকর্তা করে পাঠান। এদিকে দাউদ সুযোগ বুঝে পুনরায় মোঘলদের বিরম্নদ্ধে অস্ত্র ধরলে খাঁ জাহানের সাথে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন এবং এরই মাধ্যমে গৌড়ে পাঠান রাজত্বের অবসান ঘটে।১৯
তাই একথা বলা যায় যে ১৫৭৪ সালে দাউদ গৌড়ের রাজত্বকালীন সময়েই যশোর রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়। প্রায় দুইশত বছর ধরে গৌড়ে যে সম্পদ গচ্ছিত হয়েছিলো তার প্রায় সমুদয় সম্পদ বিক্রমাদিত্যের হাত ধরে যশোর রাজ্যে এসে জমা হলো। তবে ঐতিহাসিকদের মতে ‘যশোরেশ্বরী দেবী’র পীঠ মুর্তির আবিষ্কার ও ‘কার্ষাপন বা পুরান’ নামক রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন এবং ‘দিগ্বিজয় প্রকাশ’ নামক গ্রন্থে উলেখ লক্ষণ সেনের ‘যশোরেশ্বরী দেবী’র নামে চন্ডভৈরবে মন্দির নির্মান প্রমান করে যে যশোর বিক্রমাদিত্যের পূর্বেই এক গৌরবময় রাজ্য ছিল। ভিনসিন্ট স্মিথ ও অন্যান্য বিখ্যাত মুদ্রাতাত্ত্বিকের গবেষনায় এ বক্তব্য আরো স্পষ্ট হয়।২০
আর মজার বিষয় হলো তখনকার সেই প্রাচীন রাজ্যের নাম ছিল ‘যশোর’। যা বহুবছর পর সুপন্ডিত বসমত্মরায়ের হাতে গৌড়ের যশ হরণ করে নাম ধারন করলো ‘যশোহর’। সুতরাং সেই অর্থে ‘যশোহর’ একটি আধুনিক নাম এবং ‘যশোর’ প্রাচীন নাম। প্রতাপাদিত্যের আমলের পূর্বে লিখিত কোন বইতে ‘যশোহর’ নামে যশোরকে অভিহিত করা হয় নাই। তখনকার দিনে যশোরের সীমানা ছিল পূর্বভাগে মধুমতী নদী, উত্তরে কেশবপুর, পশ্চিমে কুশদ্বীপ ও প্রাচীন ভাগীরথী খাত ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। কুশদ্বীপ ও কুশদাহ ছিল বসিরহাট ও বনগ্রাম মহাকুমার অমত্মর্গত।২১
ধীরে ধীরে বাংলার এই ভবিষ্যত রাজনৈতিক গুরম্নত্বপূর্ণ স্থানের প্রতি সবার দৃষ্টি পড়তে লাগলো। নবনির্মিত, সুসজ্জিত ও সুরক্ষিত যশোরের প্রতিপত্তির কাহিনী তখন লোকমুখে গৌড়ে গিয়ে পৌঁছেছিল। সুতরাং শুধু স্বাধীনতা লাভের জন্য নয়, জীবন ধারণের জন্যও দলে দলে মানুষ যশোরে এসে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। ক্রমান্বয়ে যশোর জনবহুল জনপদে পরিণত হয়। এই সময় খাঁ জাহানের নিকট দায়ুদের শেষ পরাজয় ও হত্যা হলো। বিক্রমাদিত্য ও বসমত্মরায় দাউদের সঙ্গে সঙ্গেই ছিলেন, কিন্তু দাউদের মৃত্যুর পর আত্মরক্ষার জন্য তারা ছদ্মবেশে গা ঢাকা দিলেন।২২
এ সময় মোঘলরা জানতে পারলেন যে গৌড়ের সমসত্ম হিসাব বিক্রমাদিত্য, বসমত্ম রায় ও শিবানন্দ প্রভৃতি ব্যক্তির করায়ত্ত রয়েছে। তাই তারা তাদের আত্মসমর্পণ করতে বলেন। অবশেষে বিক্রমাদিত্য ও বসমত্মরায় ছদ্মবেশ ত্যাগ করে রাজা টোডরমলের কাছে গিয়ে হাজির হন এবং সমসত্ম হিসাব পেশ করেন। সেখানেই বিক্রমাদিত্য মোঘল বাদশাহ কর্তৃক ‘সামামত্মরাজ’ হিসেবে স্বীকৃত হন। বিক্রমাদিত্য টোডরমলের বিশেষ আনুগত্যও পেয়েছিলেন যার ফলশ্রম্নতিতে তিনি ১৫৭৭ সালে যশোর রাজ্যের বাদশাহী
সনদ লাভ করেন। ১৫৭৭ সালে যশোরে ফিরে এলে বিক্রমাদিত্য রাজ সিংহাসনে সমাসীন হন। গৌড়ের নিষ্কন্টক ধনসম্পদের উত্তরাধিকারী বিক্রমাদিত্য ও বসমত্মরায় মোঘল বাদশাহের সাথে সন্ধিতে আবদ্ধ হয়ে শামিত্মর সাথে যশোর রাজ্যে শাসন করতে থাকেন। অনেকদিন পর দক্ষিণবঙ্গ অরাজকতার হাত থেকে মুক্ত হয়ে শামিত্মর মুখ দেখে এবং প্রজাদের সুখ ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়।২৩
জে. ওয়েস্টল্যান্ড কর্তৃক লিখিত যশোর জেলার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজা প্রতাপাদিত্যের নাম উলেখ ব্যতীত যশোরের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যদিও তার ভবনের ধ্বংসস্ত্তপ ২৪ পরগনা জেলায় অবস্থিত। রাজা বিক্রমাদিত্য যে শহরের পত্তন করেন তাই হলো আজকের যশোর। গৌড়ের রাজা দাউদের রাজসভায় বিক্রমাদিত্য ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। গৌড় ছিল বাংলার সর্বশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। আনুমানিক ১৫৭৩-৭৪ খ্রিঃ যখন রাজা দাউদ দিলির সম্রাটের বিরোধিতা করেন, তখন একজন বিচক্ষণ উপদেষ্টা হিসেবে রাজা বিক্রমাদিত্য এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে শীঘ্রই বড় কোন ধ্বংসযজ্ঞ শুরম্ন হতে চলেছে এবং একই সাথে মনস্থির করেন এমন একটি স্থানে পরিবারকে নিয়ে যাওয়ার যেখানে তিনি জীবনের শেষ সময় নিশ্চিমেত্ম কাটাতে পারবেন। এই চিমত্মার ফলশ্রম্নতিতে তিনি সুন্দরবনের নিকটবর্তী একটা রাজ্য কিনে নেন। যে রাজ্যে প্রবেশাধিকার ছিল দূরবর্তী ও দূরহ এবং এখানেই তিনি একটা শহরের পত্তন করেন। তিনি ও তার পরিবার ও তার একামত্ম অনুগত লোকদের নিয়ে গৌড় থেকে এই নতুন রাজ্যে চলে আসেন। এই শহরের নাম বিক্রমাদিত্য রাখেন ‘ইয়াশোরা’। যখন গৌর রাজ্যের সবকিছুই রাজা দাউদের বিপক্ষেযাচ্ছিল, এবং বিক্রমাদিত্যও বুঝতে পারছিলেন যে তাকে নতুন রাজ্যে চলে যেতে হবে, তিনি সেইভাবে প্রস্ত্ততি নিতে থাকেন। রাজা দাউদ তার রাজ্যে গচ্ছিত সোনা ও মহামূল্যবান সম্পদ কোন নিরাপদ নগরীতে স্থানামত্মর বুদ্ধিমানের কাজ মনে করে বিক্রমাদিত্যকে অনুরোধ করলেন তার ধনসম্পত্তি সাথে করে নিয়ে যেতে।
No comments