Header Ads

Header ADS

যশোর জেলার প্রাচীন ইতিহাস

 

যশোর জেলার প্রাচীন ইতিহাস

যশোর জেলার প্রাচীন ইতিহাস

বর্তমান যশোর জেলা প্রাচীনকালে বহু নদ-নদী দ্বারা বিভক্ত ছিল। নদী বিধৌত এ অঞ্চলে মাঝি ও জেলে সম্প্রদায়ের কিছু বিচ্ছিন্ন উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে টলেমীর মানচিত্রে দেখা যায়, বঙ্গীয় ব-দ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলের ভূ-ভাগ মূলত গঙ্গার দু’টি প্রধান শাখা পদ্মা ও ভাগীরথীর বাহিত পলি দ্বারা গঠিত হয়েছিল। মহাভারত, রঘুবংশ এবং অন্যান্য পুরাণের প্রাপ্ত বর্ণনায় দেখা যায়, বঙ্গীয় ব-দ্বীপের এই অংশটুকু প্রাচীনকালের দু’টি শক্তিশালী রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত ছিল। সু-প্রাচীন এ রাজ্য দু’টি হল পশ্চিমবঙ্গের অমত্মর্গত সুহম বা রাধা এবং পূর্ববঙ্গের অমত্মর্গত বঙ্গ। সুহাম বা রাধা তাম্রলিপি নামেও পরিচিত ছিল। স্ব-স্ব শাসকদের শক্তিমত্তা ও ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে মূলত রাজ্য দু’টির সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় খ্রিস্টীয় ৫ম শতকে বর্তমান যশোর জেলা বঙ্গ  রাজ্যের শাসনাধীনে আসে।

 

খ্রিস্টীয় ১ম ও ২য় শতক

টলেমীর বর্ণনায় দেখা যায় যে, খ্রিস্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে বর্তমান যশোর জেলাসহ বঙ্গীয় ব-দ্বীপের সম্পূর্ণ অংশ নিয়ে একটি শক্তিশালী রাজ্য গঠিত হয়েছিল। এ রাজ্যের রাজধানী স্থাপিত হয়েছিল ‘গঙ্গা’ নামক স্থানে। তৎকালীন সময়ে ‘গঙ্গা’ ছিল একটি বিখ্যাত রাজার নগরী। এ নগরীটি বিখ্যাত গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। টলেমীর বর্ণনানুযায়ী রাজধানী শহরটি তাম্রলিপির দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে অবস্থিত ছিল। ঐ সময়ের ইতিহাস বেশ অস্পষ্টতার ধূম্রজালে জড়ানো থাকায় যশোরের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা দূরহ ব্যাপার। ১

 

গুপ্ত সাম্রাজ্য (খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতক থেকে ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত)

 

খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের শুরম্নর দিকে বঙ্গদেশে বেশ কিছু স্বাধীন রাজ্য বিসত্মারলাভ করেছিল। কিন্তু ভারতবর্ষের উত্তরাংশে গুপ্ত সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের সাথে সাথে এ সমসত্ম রাজ্যসমূহের স্বাধীন সত্তার বিলুপ্তি ঘটে। এলাহাবাদে প্রাপ্ত (সত্মম্ভ) শিলালিপি থেকে দেখা যায় রাজা সমুদ্রগুপ্ত (৩৪০-৩৮০ খ্রিঃ) বঙ্গদেশের পশ্চিম এবং উত্তরাঞ্চল গুপ্ত সাম্রাজ্যের অমত্মর্ভুক্ত করেন। এমনকি সমতটের (পূর্ববঙ্গ) শাসনকর্তাও গুপ্ত সম্রাটের সার্বভৌম কর্তৃত্বকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এভাবে যশোর জেলাটি গুপ্ত শাসকবর্গের অধীনে আসে এবং খুব সম্ভবত খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যমত্ম তাদের দ্বারাই শাসিত হয়। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়ে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এ সময় ভারতবর্ষের উত্তরাংশে বেশ কিছু সংখ্যক স্বাধীন রাজ্যের জন্ম হয়। বঙ্গদেশেও দু’টি স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। প্রথমটি ছিল বঙ্গ বা সমতট এবং দ্বিতীয়টি ছিল গৌড় । উত্তর ও পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিবঙ্গের একটি অংশ ও তৎকালীন বঙ্গ তথা সমতট রাজ্যের অমত্মর্ভুক্ত হয়। এই ধারাবাহিকতায় বর্তমান যশোর জেলা বঙ্গ রাজ্যের অধীনে আসে। ২

 

গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য এবং শ্যামচার দেব (৫২৫-৫৭৫ খ্রিঃ)

 

ফরিদপুর জেলার নিকটবর্তী কোটালিপাড়া থেকে আবিষ্কৃত পাঁচটি এবং বর্ধমান (ভারতে অবস্থিত) জেলা থেকে আবিষ্কৃত অপর একটি শিলালিপি থেকে এই রাজ্যেও তিনজন শাসনকর্তা সম্পর্কে জানা যায়। তারা হলেন গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য এবং শ্যামচার দেব। তাদের নামের আগে যুক্ত ‘মহারাজা’ পদবি প্রমাণ করে যে তারা প্রত্যেকেই ছিলেন স্বাধীন এবং ক্ষমতাধর নৃপতি। কিন্তু এ তিনজন রাজার  পারস্পারিক সম্পর্ক এবং তাদের উত্তরাধিকারের ক্রম সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে সাভার (ঢাকা জেলা) এবং (ফরিদপুর জেলা) থেকে বিপুল সংখ্যক স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়। এসব স্বর্ণমুদ্রা থেকে ধারণা করা যায় যে, শ্যামচার দেবের পরেও এ অঞ্চলে বেশ কয়েকজন রাজার অসিত্মত্ব ছিল। এ সমসত্ম রাজাগণ সম্ভবত বঙ্গ শাসন করতেন। তারা শ্যামচার দেবের প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের শেষ সময়কার রাজা ছিলেন। ইতিহাসে তাদের সম্পর্কে স্পষ্ট এবং বিসত্মারিত ধারণা পাওয়া যায় নি। তবে এই রাজাগণের দ্বারা প্রদত্ত ছয়টি অনুদান থেকে প্রাদেশিক প্রশাসন সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়। এগুলো প্রমাণ করে যে, বঙ্গদেশে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থা ছিল যা জনগণের জন্য শামিত্ম ও সমৃদ্ধি নিয়ে এসেছিল।

খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের শেষ ভাগে চালুক্যের নৃপতি কীর্তিবর্মন (৫৬৭-৫৯৭ খ্রিঃ) বঙ্গ রাজ্য আক্রমণ করেন। মূলত কীর্তিবর্মনের আক্রমণের মধ্য দিয়েই শ্যামচারদেবের উত্তরাধিকারীদের শাসনের অবসান ঘটে। কীর্তিবর্মন বঙ্গ বিজয়েরও দাবি করেন। যদিও তার সফলতার প্রকৃতি এবং ব্যাপ্তি সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি তবুও একথা বলা যায় যে, তার আক্রমণের মধ্য দিয়েই ‘বঙ্গ’ রাজ্যের পতনের সূত্রপাত হয়।

 

খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের সূচনালগ্নে বর্তমান যশোর জেলা খুব সম্ভবত গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক (৬০৬-৬৩৭/৩৮ খ্রিঃ) এর অধীনে আসে। শশাঙ্ক শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গকে একত্রিত করে একটি স্বাধীন রাজ্যেই প্রতিষ্ঠা করেন নি, তিনি সমগ্র দক্ষিণ বিহার ও উড়িষ্যাতেও তার প্রভাব বিসত্মার করেছিলেন। কিন্তু একথা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয় যে, দক্ষিণবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গও শশাঙ্কের সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। তবে পন্ডিতগণ এ অঞ্চলে ‘ভদ্র’ নামে অভিজাত একটি পরিবারের কথা বলেন, যারা এ অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন। ৩

 

রাজা হর্ষবর্ধন (৬০৬-৬৪৭ খ্রিঃ)

 

রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বর্তমান যশোর জেলা উত্তর ভারতের মহান হিন্দু রাজা হর্ষবর্ধনের (৬০৬-৬৪৭ খ্রিঃ) অধিকারে আসে। বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর বর্ণনায় এ তথ্য পাওয়া যায়। হিউয়েন সাঙ হর্ষবর্ধনের শাসনামলে ৬৩৮ মতামত্মরে ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশ পরিভ্রমণ করেন। তিনি ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে তার ভ্রমণ সম্পর্কিত মূল্যবান বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। হিউয়েন সাঙ বঙ্গীয় ব-দ্বীপের নিম্নাঞ্চলে দু’টি রাজ্যের অসিত্মত্বের কথা বলেন। এর একটি ছিল সমতট, অন্যটি তাম্রলিপি। সমতট রাজ্যের অন্য নাম ছিল বঙ্গ। বঙ্গ ছিল সমুদ্রতীরবর্তী নিম্নভূমি; যা ছিল শস্য, ফুল এবং ফলে সমৃদ্ধ। আই চিঙ নামক অন্য একজন চীনা পরিব্রাজকও এ অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। তিনিও তার বর্ণনায় সমতট রাজ্যের কথা বলেন। তখন সমতটের রাজা ছিল‘হো-লো-শি-পো-তা’ যার সংস্কৃত অর্থ হর্ষবর্ধন। ৪

 

ভদ্র রাজবংশ (খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধ)

 

হিউয়েন সাঙ এর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ব্রাহ্মণ রাজাদের একাংশ ভদ্র রাজবংশের অমত্মর্ভুক্ত ছিল। তারা খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধ পর্যমত্ম সমতট এবং খুব সম্ভবত বর্তমান যশোর জেলা শাসন করতেন। নালন্দার গোষ্ঠীপতি শিলাচন্দ্র এ অভিজাত পরিবারের বংশধর ছিলেন। কিন্তু এ রাজবংশের অসিত্মত্ব সম্পর্ক বিসত্মারিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। ৫

 

খড়গ রাজবংশ (খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের দ্বিতীয় অর্ধাংশ)

 

খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের শেষার্ধে খড়গ নামযুক্ত অপর একটি বৌদ্ধ রাজবংশের কথা জানা যায়। এ রাজবংশ সমতট এবং খুব সম্ভবত যশোর জেলাও শাসন করত। এ রাজবংশ খড়গ রাজবংশ নামে পরিচিত ছিল এবং এদের হাতেই ভদ্র রাজবংশের পতন হয়েছিল। ঢাকা জেলার আশরাফপুরে প্রাপ্ত তাম্রফলক থেকে এ রাজবংশের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। তাম্রফলকটিতে খড়গ রাজবংশের তিনজন বিশিষ্ট রাজার নাম পাওয়া যায়। তারা হলেন খড়গদায়ম, তার পুত্র জাতাখড়গ এবং জাতাখড়গ এর পুত্র দেবখড়গ। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ।৬

 

যশোবর্মন (৭২৫-৭৩৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি)

 

খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের শেষার্ধে এবং ৮ম শতকের প্রথমার্ধে এ বঙ্গদেশ বিদেশী আগ্রাসনের শিকার হয়। গৌড় এবং মগধ রাজাদের ন্যায় বঙ্গের খড়গ শাসকদেরও এ আগ্রসনের কবলে পড়তে হয়েছিল। খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে কনৌজ অধিপতি যশোবর্মনের আগ্রাসন বেশ উলে­খযোগ্য। ৭২৫ থেকে ৭৩৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি কোন সময়ে যশোবর্মনের হাতে গৌড় রাজ্যের পরাজয় ও পতন ঘটে। গৌড় বিজয়ের পর বঙ্গ এবং বর্তমান বঙ্গদেশের সিংহভাগ তার দখলে আসে। কিন্তু তার শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি এবং এ শাসনের ধরণ সম্পর্কেও বিসত্মারিত তথ্য পাওয়া যায় নি।৭

 

পাল রাজবংশ (৭৮১-১০৮০ খ্রিঃ)

 

খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের মাঝামাঝি সময়ে পালগণ উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। খুব সম্ভবত পাল রাজবংশের দ্বিতীয় শাসক ধর্মপালের (৭৮১-৮২১ খ্রিঃ) শাসনামলে বর্তমান যশোর জেলার উপর তাদের কর্তৃত্ব কায়েম হয়। রাজা ধর্মপাল তার পিতার নিকট থেকে একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন। কিন্তু তার পরাক্রম ও কূটনীতি এবং সেই সাথে ভাগ্যের পরশ তাকে ভারতবর্ষের উত্তরাংশে একট সুবিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছিল। তিনিই পাল রাজাগণের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যিনি ‘পরমেশ্বর’ এবং ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধিতে ভূষিত হন। তিনিও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী এবং পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। রাজা ধর্মপাল ৭৮১ থেকে ৮২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যমত্ম দীর্ঘসময় শাসন করেছিলেন এবং তার শাসনামলে বর্তমান যশোর জেলার উপরও পালদের কর্তৃত্ব বজায় ছিল।

ধর্মপালের পর তার পুত্র দেবপাল (৮২১-৮৬১ খ্রিঃ) সিংহাসনে আরোহণ করেন। দেবপালও তার পিতার ন্যায় অত্যমত্ম যোগ্যতাসম্পন্ন রাজা ছিলেন। তিনি তার প্রজ্ঞা ও পরাক্রমের সাহায্যে কেবলমাত্র তার পিতার সাম্রাজ্য টিকিয়েই রাখেননি বরং তার আমলে পাল সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ বিসত্মার সাধিত হয়েছিল। ধর্মপালের ন্যায় দেবপালও দীর্ঘ সময় পর্যমত্ম শাসন করেন এবং যশোর জেলার উপরও তার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বজায় ছিল। তিনিও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে তিনি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। দেবপালের পর পাল রাজবংশের অন্য রাজাগণ হলেন রাজা প্রথম সুরপাল (৮৬১-৮৬৬ খ্রীঃ)। প্রথম সুরপাল বিগ্রহপাল নামেও পরিচিত ছিল। তার পরবর্তী রাজাগণ হলেন নারায়ণপাল (৮৬৬-৯২০ খ্রিঃ), রাজপাল (৯২০-৯৫২ খ্রিঃ), দ্বিতীয় গোপাল (৯৫২-৯৬৯ খ্রিঃ) এবং দ্বিতীয় বিগ্রহপাল (৯৬৯-৯৯৫ খ্রিঃ)। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন দুর্বল শাসক। তাদের শাসনামলে বিদেশী আগ্রাসনের কারণে সুবিশাল পাল সাম্রাজ্য ক্রমশ ছোট হতে থাকে। খ্রিস্টীয় দশম শতকের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে গন্ধ্ররা একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা পাল রাজাদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল। এমনকি পাল সাম্রাজ্যের ভিতরেই উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গে কামবোজা শাসকগণ নিজেদের স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করে। ফলশ্রম্নতিতে রাজা প্রথম মহীপালের সিংহাসনে আরোহণের পূর্ব পর্যমত্ম পাল শাসন আংগা এবং মগধ এ সীমিত হয়ে পড়ে। রাজা প্রথম মহীপালের (৯৯৫-১০৪৩ খ্রিঃ) সিংহাসনে আরোহণের সাথে সাথে ক্ষয়িষ্ণু পাল সাম্রাজ্যের সুদিন ফিরে আসতে শুরম্ন করে। তিনি সিংহাসনে আসীন হয়ে দেখতে পান পাল সাম্রাজ্য মূলত দক্ষিণ বিহার পর্যমত্ম সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তিনি সফলতার সাথে তার শত্রম্নদের নিধন করেন এবং কামবোজা শাসকদের কাছ থেকে উত্তর রাধা ও উত্তরবঙ্গ পুনরম্নদ্ধার করেন। প্রথম মহীপাল তার শাসনামলে উত্তর বিহার পর্যমত্ম পাল কর্তৃত্ব বিসত্মার করতে সফল হয়েছিলেন ফলে পাল সাম্রাজ্য পুনঃ প্রতিষ্ঠা করার কৃতিত্ব অবশ্যই তাকে দেয়া যায়। উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এ সময় যশোর জেলার উপরও পাল কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজা প্রথম মহীপালের পরবর্তী উত্তরাধিকারীগণ হলেন ন্যায় পাল (১০৪৩-১০৫৮ খ্রিঃ) এবং তৃতীয় বিগ্রহপাল (১০৫৮-১০৭৪ খ্রিঃ) তাদের শাসনামলে কালাচুরি’র নৃপতি লক্ষীকর্ণ বঙ্গদেশের এ অংশে বারবার অভিযান চালান। লক্ষীকর্ণের নেতৃত্বে সংগঠিত ক্রমাগত বিদেশী আগ্রসন পাল সাম্রাজ্যের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল। পাল রাজাগণ এসময় কেবলমাত্র পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তরবঙ্গের কর্তৃত্বই হারান নি, বরং মগধের এর উপরও তাদের কর্তৃত্ব ক্রমশ কমে আসতে শুরম্ন করে। তৃতীয় বিগ্রহপালের পুত্র ছিলেন দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭৫-১০৮০ খ্রিঃ)। দ্বিতীয় মহীপাল তার শাসনামলের প্রথমদিকে যশোর জেলার উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তীতে এ অঞ্চল বর্মনদের দখলে চলে যায়। উত্তবঙ্গের কৈর্বত্র বিপ­বের সুযোগে এ অঞ্চল বর্মনদের দখলে চলে যায় এবং ১০৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে তারা স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।৮

 

বর্মন শাসনামল

 

খুব সম্ভবত বঙ্গে কালাচুরি কর্ণের আগ্রাসনের সময়ই বর্মনদের আগমন ঘটে। বর্মনরা আগ্রাসনের সময় লক্ষীকর্ণকে সহযোগিতা করে এবং এদেশে থেকে যায়। পরবর্তীতে সুবিধামত সময়ে তারা নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এ রাজবংশের প্রসিদ্ধ শাসকগণ হলেন ভজরাবর্মণ, জাতবর্মন, হরিবর্মন, সমলবর্মন এবং ভোজবর্মন। বর্মনরা সনাতন বেদ এর অনুসারী ছিলেন। পরবর্তীতে তারা ‘সেন’ নামক আর একটি ব্রাহ্মণ সনাতন রাজবংশ দ্বারা উৎখাত হন।৯

 

সেন রাজবংশ(১১৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে খ্রিস্ট্রীয় ১৩ শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত)

 

রাজা বিজয়সেনের সময় বঙ্গদেশের এ অংশে এবং যশোর জেলার উপর সেন রাজবংশের শাসনের সূত্রপাত হয়। রাজা বিজয়সেন সেন রাজবংশের তৃতীয় রাজা ছিলেন (১০৯৭-১১৬০ খ্রিঃ)। সুবিশাল সেন সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রসত্মর তার হাতেই রচিত হয়েছিল। তিনি প্রায় সমগ্র বঙ্গদেশ জয় করেছিলেন। তবে বর্মন শাসকদের কাছ থেকে তার পূর্ববঙ্গ(সমতট) বিজয়ের সঠিক সময় সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত তিনি তার শাসনামলের শেষ সময়ে যশোর জেলার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার উত্তরসূরি বল­vল সেন (১১৬০-১১৭৮ খ্রিঃ) এবং লক্ষণসেন (১১৭৮-১২০৬ খ্রিঃ) ও এ জেলার উপর তাদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। লক্ষণসেনের শাসনামলেই ১২০৪ খ্রিঃ বঙ্গদেশে বিখ্যাত মুসলিম আগ্রাসনের সূত্রপাত ঘটে। শিহাবুদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরীর সেনাপতি মালিক ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ-বিন-বখতিয়ার-খিলজী এ সময় বঙ্গদেশ আক্রমন করেন। যখন বখতিয়ার খিলজী তার সেনাবাহিনী নিয়ে লক্ষণসেনের রাজধানী নদীয়ায় পৌঁছেন তখন রাজা লক্ষণসেন তার দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। মুসলিম সেনাবাহিনীর আগমনের সংবাদ শুনে তিনি নগ্নপদে তার রাজধানী হতে নৌকাযোগে বিক্রমপুরে পালিয়ে যান। ১২০৬ খ্রিঃ তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যমত্ম সময় তিনি সেখানে শাসনকার্য পরিচালনা করেন।১০

 

মুসলমান যুগ

 

১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজীর নদীয়া বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয়। কিন্তু মুসলিম সাম্রাজ্য তখনো পর্যমত্ম লক্ষণাবর্তীর চারপাশে কিছু সংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখন্ডে সীমাবদ্ধ ছিল। সুতরাং কেবলমাত্র নদীয়া বিজয়ের সাথে সাথেই যশোর জেলা লক্ষণাবর্তীর মুসলমান শাসকদের অধীনে আসেনি। সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইত্তয়াজ খিলজি-ই (১২১৩-১২২৭) হচ্ছেন লক্ষণাবর্তীর প্রথম শাসক যিনি দক্ষিণ এবং পূর্বে মুসলিম সাম্রাজ্য বিসত্মারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু তার শাসনামলেও যশোর জেলা লক্ষণাবর্তীর অমত্মর্ভুক্ত হয়নি। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শেষার্ধে সুলতান মুঘিসুদ্দিন তুঘরালের (১২৬৮-১২৮১) শাসনামলে এ জেলা লক্ষণাবর্তী রাজ্যের অধীনে আসে। স্যার জে.এন. সরকারের প্রদত্ত বক্তব্য থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। তিনি তার  গ্রন্থে বলেন,

 

"The power of the Seans was on the verge of extinction in the second half of the thirtenth century on account of Muslim attacks from the west... the Muslim possessions in Bengal included at least some portions of East Bengal (Bangladesh).... [Source : Sir J.N. Sarker; History of Bengal, Voll-II, Page-57].

 

সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবন (১২৬৬-১২৮৭ খ্রিঃ) এর শাসনামলে যশোর জেলার উপর দিল­xর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। লক্ষণাবর্তী রাজ্যের গভর্ণর সুলতান মুঘিসুদ্দিন তুঘরাল ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যমত্ম এ জেলা শাসন করেন। তিনি ছিলেন সর্বশেষ এবং সবচেয়ে মহান রাজা তিনি সামান্য ক্রীতদাস থেকে বাংলার সার্বভৌম ক্ষমতার আসনে আসীন হয়েছিলেন। কিন্তু তার জীবনের করম্নণ পরিণতি ঘটে। কারণ তিনি দিল­xর শাসকবর্গের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। লক্ষণাবর্তী রাজ্যের উপর তার স্বাধীন শাসন খুব স্বল্প সময় স্থায়ী হয়েছিল। সুলতান মুঘিসুদ্দিন তুঘরল এর মৃত্যুর পর সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবন এর পুত্র শাহজাদা নাসিরম্নদ্দিন মুহাম্মদ বুঘরা খান লক্ষণাবর্তীর গভর্ণর নিযুক্ত হন। তিনি ছয় বৎসর এ রাজ্য শাসন করেন। তার  শাসনামল ছিল ১২৮১ থেকে ১২৮৭ খ্রিঃ পর্যমত্ম। ১২৮৭ খ্রিঃ তার পিতার মৃত্যুর পর তিনি সুলতান নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ উপাধি লাভ করেন। এ সময় থেকেই লক্ষণাবর্তী রাজ্যের স্বাধীন স্বত্তা দিল­xর সালতানাতের স্বীকৃতি পেতে শুরম্ন করে। সেসময় থেকে ১২২৪ খ্রিঃ পর্যমত্ম যশোর জেলা লক্ষণাবর্তীর শাসকদের অধীনে ছিল। ১৩২৪ খ্রিঃ সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক লক্ষণাবর্তীকে তার সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত করেন এবং স্বাভাবিক কারণেই যশোর জেলা পুণরায় দিল­xর সালতানাতের এর অধীনস্থ হয়।১১

 

ইলিয়াসশাহী শাসন (১৩৪২-১৪১৪ খ্রিঃ এবং ১৪৪২-১৪৮৬ খ্রিঃ)

 

মুহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বের শেষ সময়ে রাজ্যব্যাপী বিদ্রোহ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে তার কর্তৃত্ব ক্রমশ কমে আসতে শুরম্ন করে। এসময় সমগ্র লক্ষণাবর্তী রাজ্য তিন খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফখরম্নদ্দিন, ইলিয়াস এবং আলীশাহ পৃথক পৃথকভাবে পূর্ব, দক্ষিণ এবং পশ্চিম অংশ শাসন করতেন। পরবর্তীতে ১৩৪২ খ্রিঃ ইলিয়াস শাহ যখন লক্ষণাবর্তীর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন তখন যশোর জেলা পুনরায় লক্ষণাবর্তীর অধীনে চলে যায়। এভাবে লক্ষণাবর্তীর সিংহাসনে ইলিয়াস শাহের আরোহণের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। তিনি শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ উপাধি লাভ করেন। এটি ছিল হিজরি ৭৪৩ সন এবং ১৩৪২ খ্রিঃ এর ঘটনা।

 

সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সমগ্র মুসলিম বঙ্গকে একত্রিত করে একটি রাজতন্ত্রের অধীনে এনেছিলেন এবং ১৩৫৭ খ্রিঃ তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যমত্ম সময় এ কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। তার উত্তরসূরিগণ হলেন সিকান্দার শাহ (১৩৫৭-১৩৯২) গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৯২-১৪১০) সাইফুদ্দিন হামজাহ শাহ (১৪১০-১৪১১ খ্রিঃ) শিহাবুদ্দিন বায়েজিদ শাহ (১৪১২-১৪১৪) এবং আলাউদ্দিন ফিরোজশাহ (১৪১৪ থেকে রাজা গণেশের উত্থান পর্যমত্ম সময়)। এসময় যশোর জেলা লক্ষণাবর্তী রাজ্যের অংশ হিসেবে তাদের দখলে ছিল। ১৪৮৭ সালে ইলিয়াস শাহী বংশের পতন ঘটিয়ে দাস বংশ তাদের রাজত্ব শুরম্ন করে। দাস রাজাগণ ১৪৯৩ খ্রিঃ পর্যমত্ম এখানে তাদের অধিকার টিকিয়ে রাখেন। দাস বংশের পতনের পর যশোর সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এর শাসনাধীন চলে যায়। ১৫৩৮ খ্রিঃ পর্যমত্মত্ম হুসেন শাহী বংশ এ অঞ্চলে তাদের শাসনকাল বজায় রাখে।১২

 

সম্রাট শেরশাহ (১৫৩৯-১৫৪৫ খ্রিঃ)

 

পরবর্তীতে গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ এর শাসনামলে দিল­xর প্রসিদ্ধ পাঠান সম্রাট শেরশাহ (১৫৩৯-১৫৪৫) বঙ্গদেশ দখল করলে যশোর তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। ১৫৪৫ খ্রিঃ শেরশাহ এর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরি ইসলাম শাহ ১৫৫৩ সাল পর্যমত্ম এ জেলার উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখেন। এ রাজবংশের পর যশোর জেলার কর্তৃত্ব চলে যায় কররানি পরিবারের হাতে। তাজ খান কররানি ছিলেন এ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর উলে­খযোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন সুলাইমান কররানি (১৫৬৫-১৫৭২) এবং দাউদ কররানি (১৫৭২-১৫৭৬) মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হবার পূর্ব পর্যমত্ম যশোর জেলার উপর তাদের কর্তৃত্ব কায়েম ছিল।১৩

 

মুঘল শাসনামল (১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রিঃ)

 

পাঠান রাজত্বের পর বিখ্যাত মোঘল রাজবংশ এ উপমহাদেশের বিশাল অঞ্চল জুড়ে তাদের স্মরণীয় শাসনকালের সূচনা করে। এ সময় সুবিখ্যাত মোঘল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) প্রথম এ অঞ্চলে ফৌজদার নিযুক্ত করে শাসন কার্য পরিচালনা করেন। বার ভূঁইয়াদের অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্য এ সময় এ জেলা শাসন করতেন। যশোরের প্রথম ফৌজদার ছিলেন ইনায়েত খাঁ। এরপর সরফরাজ খাঁ, নুরম্নল­vখাঁ পর্যায়ক্রমে যশোর এর ফৌজদার নিযুক্ত হয়ে আসেন। নবাবী শাসনামলে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ (১৭০৩-১৭২৬) এর শাসনামলে সীতারাম রায় নামক একজন স্থানীয় রাজা কর্তৃক যশোর জেলা শাসিত হত। সীতারাম ছিলেন উত্তর রাঢ় বংশীয় কায়সত্ম। তার পিতা উদয় নারায়ণ ভূষণার ফৌজদারের অধীনে একজন তহশিলদার ছিলেন। রাজা সীতারাম রায়ের রাজধানী ছিল মহম্মদপুর। রাজা সীতারাম রায় মুর্শিদকুলী খাঁ কে অমান্য করলে নবাব তার বিরম্নদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন। যুদ্ধে সীতারাম পরাজিত হন। সীতারামের পতনের পর যশোর জেলা কয়েকটি জমিদারীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। নাটোর এর জমিদার জেলার পূর্বাংশ, চাঁচড়ার জমিদার জেলার দক্ষিণাংশ এবং নলডাঙ্গার জমিদার জেলার উত্তরাংশ তাদের জমিদারির অমত্মর্ভুক্ত করে নেয়। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে গৌড়ের শাসনকর্তা দাউদের একজন বিশ্বসত্ম সহযোগী শ্রীহরি ১৫৭৪ সালে যশোর এর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং স্বাধীন যশোর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাসে এই শ্রীহরিই মহারাজ বিক্রমাদিত্য নামে পরিচিত। বিক্রমাদিত্য গৌড়ের রাজা দাউদ কর্তৃক প্রদত্ত উপাধি। বিক্রমাদিত্যের রাজধানী ছিল ঈশ্বরপুর এবং ত্রেকাটিয়াতে। ১৫৮৩ খ্রীস্টাব্দে বিক্রমাদিত্য মৃত্যুবরণ করেন। বিক্রমাদিত্যের শাসনকালে তার বিশ্বসত্ম সহযোগী ও জ্ঞাতি ভ্রাতা বসমত্মরায়ই যশোরের প্রকৃত শাসক ছিলেন। গৌড় থেকে নিয়ে আসা অঢেল ধন-সম্পদ দ্বারা বসমত্মরায় যশোরকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করে গড়ে তোলেন। বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর কয়েক বছর পর ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে তার পুত্র প্রতাপাদিত্যকে বসমত্মরায় যশোরের রাজা বলে ঘোষণা করেন। প্রতাপাদিত্যের প্রকৃত নাম ছিল গোপীনাথ। ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি গৌড়ে জন্মগ্রহণ করেন। প্রতাপাদিত্য ছিল তার প্রাপ্ত উপাধি। সুন্দরবন অঞ্চলের ধুমঘাট ছিল তার রাজধানী। ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে দিল­xর সম্রাট নাসির শাহ অথবা মাসুদ শাহ খাজা জাহান বা খাঁন জাহান আলী নামক একজন সুফি দরবেশকে বঙ্গদেশে প্রেরণ করেছিলেন। খাজা জাহান বা খাঁন জাহান আলী সম্রাট মামুদ শাহ কর্তৃক প্রদত্ত উপাধি। তাঁর প্রকৃত নাম উলুখ খাঁন। বঙ্গদেশে এসে খাঁন জাহান আলী যশোর অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেন। পরবর্তীকালে তিনি একজন বিখ্যাত ইসলামী সাধক ও ধর্ম প্রচারক হিসেবে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। যশোরের পয়গ্রাম কসবা খাঁন জাহান আলীর রাজধানী ছিল।১৪

 

ব্রিটিশ শাসনামল (১৭৫৭-১৯৪৭ খ্রিঃ)

 

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার ক্ষমতা দখল করে। লর্ড কাইভ ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ উদ-দৌলাকে (১৭৫৬-১৭৫৭) পরাজিত করলে উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য অসত্মমিত হয়। শুরম্ন হয় ইংরেজ রাজত্ব। চলে বর্ণ বৈষম্যবাদী শাসন। কোম্পানী ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের নিকট থেকে বাংলার দেওয়ানী লাভ করে। ফলে যশোর জেলা কোম্পানীর রাজস্ব প্রশাসনের অধীনে চলে যায়। প্রায় দুইশত বৎসর ইংরেজগণ উপমহাদেশে তাদের শোষণ ও নির্যাতনের শাসনকাল অব্যাহত রাখে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরম্ন করে পরবর্তী কালের নীল বিদ্রোহ, কৃষক সংগ্রাম ও স্বদেশী আন্দোলনসহ অসংখ্য বিপ­ব একের পর এক ইংরেজদের বিরম্নদ্ধে সংঘটিত হতে থাকে।১৫

 

পাকিস্তান আমল ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় (১৯৪৭-১৯৭১ খ্রিঃ)

 

অতপর ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা এদেশ থেকে বিতাড়িত হয়। ইংরেজরা উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হবার আগে এদেশে তাদের কৌশলের বীজ বুনে যায়। ফলে সৃষ্টি হয় দেশ বিভাগের। উপমহাদেশে জন্মলাভ করে দু’টি দেশ- ভারত ও পাকিসত্মান। যশোরকে তদানিমত্মন পূর্ব পাকিসত্মানের অমত্মর্ভুক্ত করা হয়। পাকিসত্মান রাষ্ট্রের দু’টি অংশ ছিল- পূর্ব পাকিসত্মান (বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিসত্মান)। পশ্চিম পাকিসত্মানীরা দীর্ঘ দুই যুগ এ অঞ্চলকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করে এবং আগ্রাসী রাজত্বের নজিরবিহীন শোষণ ও অপশাসন চালিয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের ফলে অবিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলকে করা হয় পাকিসত্মানের অংশ এবং পশ্চিমাঞ্চলকে করা হয় ভারতের। এর মধ্যে সীমানারেখা নির্ধারণের ফলে যশোর জেলার ভৌগোলিক অবস্থানের পরিবর্তন সাধিত হয়। এসময় যশোরের বনগ্রাম মহকুমাকে পুনরায় ভারতের সাথে সংযুক্ত করা হয়। ১৯৭১ সালে, বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালিরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করে। তাই ১৫৭৪ খ্রিঃ থেকে ১৯৮৪ খ্রিঃ পর্যমত্ম অব্যাহতভাবে চলতে থাকে যশোর এর গঠন ও পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়া। ১৯৬০ সালে জেলার মাগুরা মহুকুমার মহম্মদপুর থানার অংশ এবং নড়াইলের আলফাডাংগা থানাকে ফরিদপুর জেলার সাথে যুক্ত করা হয়। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রশাসনিক উন্নয়নকল্পে আজকের যশোরকে ভেঙ্গে পুনর্গঠন করেছে। ফলে জেলার চার মহকুমা নড়াইল, মাগুরা, ঝিনাইদহ এবং সদর স্বতন্ত্র চারটি জেলায় রূপামত্মরিত হয়েছে।

যশোর জেলার প্রাচীন ইতিহাস

বর্তমান যশোর জেলা প্রাচীনকালে বহু নদ-নদী দ্বারা বিভক্ত ছিল। নদী বিধৌত এ অঞ্চলে মাঝি ও জেলে সম্প্রদায়ের কিছু বিচ্ছিন্ন উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে টলেমীর মানচিত্রে দেখা যায়, বঙ্গীয় ব-দ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলের ভূ-ভাগ মূলত গঙ্গার দু’টি প্রধান শাখা পদ্মা ও ভাগীরথীর বাহিত পলি দ্বারা গঠিত হয়েছিল। মহাভারত, রঘুবংশ এবং অন্যান্য পুরাণের প্রাপ্ত বর্ণনায় দেখা যায়, বঙ্গীয় ব-দ্বীপের এই অংশটুকু প্রাচীনকালের দু’টি শক্তিশালী রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত ছিল। সু-প্রাচীন এ রাজ্য দু’টি হল পশ্চিমবঙ্গের অমত্মর্গত সুহম বা রাধা এবং পূর্ববঙ্গের অমত্মর্গত বঙ্গ। সুহাম বা রাধা তাম্রলিপি নামেও পরিচিত ছিল। স্ব-স্ব শাসকদের শক্তিমত্তা ও ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে মূলত রাজ্য দু’টির সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় খ্রিস্টীয় ৫ম শতকে বর্তমান যশোর জেলা বঙ্গ  রাজ্যের শাসনাধীনে আসে।

 

খ্রিস্টীয় ১ম ও ২য় শতক

টলেমীর বর্ণনায় দেখা যায় যে, খ্রিস্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে বর্তমান যশোর জেলাসহ বঙ্গীয় ব-দ্বীপের সম্পূর্ণ অংশ নিয়ে একটি শক্তিশালী রাজ্য গঠিত হয়েছিল। এ রাজ্যের রাজধানী স্থাপিত হয়েছিল ‘গঙ্গা’ নামক স্থানে। তৎকালীন সময়ে ‘গঙ্গা’ ছিল একটি বিখ্যাত রাজার নগরী। এ নগরীটি বিখ্যাত গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। টলেমীর বর্ণনানুযায়ী রাজধানী শহরটি তাম্রলিপির দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে অবস্থিত ছিল। ঐ সময়ের ইতিহাস বেশ অস্পষ্টতার ধূম্রজালে জড়ানো থাকায় যশোরের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা দূরহ ব্যাপার। ১

 

গুপ্ত সাম্রাজ্য (খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতক থেকে ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত)

 

খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের শুরম্নর দিকে বঙ্গদেশে বেশ কিছু স্বাধীন রাজ্য বিসত্মারলাভ করেছিল। কিন্তু ভারতবর্ষের উত্তরাংশে গুপ্ত সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের সাথে সাথে এ সমসত্ম রাজ্যসমূহের স্বাধীন সত্তার বিলুপ্তি ঘটে। এলাহাবাদে প্রাপ্ত (সত্মম্ভ) শিলালিপি থেকে দেখা যায় রাজা সমুদ্রগুপ্ত (৩৪০-৩৮০ খ্রিঃ) বঙ্গদেশের পশ্চিম এবং উত্তরাঞ্চল গুপ্ত সাম্রাজ্যের অমত্মর্ভুক্ত করেন। এমনকি সমতটের (পূর্ববঙ্গ) শাসনকর্তাও গুপ্ত সম্রাটের সার্বভৌম কর্তৃত্বকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এভাবে যশোর জেলাটি গুপ্ত শাসকবর্গের অধীনে আসে এবং খুব সম্ভবত খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যমত্ম তাদের দ্বারাই শাসিত হয়। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়ে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এ সময় ভারতবর্ষের উত্তরাংশে বেশ কিছু সংখ্যক স্বাধীন রাজ্যের জন্ম হয়। বঙ্গদেশেও দু’টি স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। প্রথমটি ছিল বঙ্গ বা সমতট এবং দ্বিতীয়টি ছিল গৌড় । উত্তর ও পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিবঙ্গের একটি অংশ ও তৎকালীন বঙ্গ তথা সমতট রাজ্যের অমত্মর্ভুক্ত হয়। এই ধারাবাহিকতায় বর্তমান যশোর জেলা বঙ্গ রাজ্যের অধীনে আসে। ২

 

গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য এবং শ্যামচার দেব (৫২৫-৫৭৫ খ্রিঃ)

 

ফরিদপুর জেলার নিকটবর্তী কোটালিপাড়া থেকে আবিষ্কৃত পাঁচটি এবং বর্ধমান (ভারতে অবস্থিত) জেলা থেকে আবিষ্কৃত অপর একটি শিলালিপি থেকে এই রাজ্যেও তিনজন শাসনকর্তা সম্পর্কে জানা যায়। তারা হলেন গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য এবং শ্যামচার দেব। তাদের নামের আগে যুক্ত ‘মহারাজা’ পদবি প্রমাণ করে যে তারা প্রত্যেকেই ছিলেন স্বাধীন এবং ক্ষমতাধর নৃপতি। কিন্তু এ তিনজন রাজার  পারস্পারিক সম্পর্ক এবং তাদের উত্তরাধিকারের ক্রম সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে সাভার (ঢাকা জেলা) এবং (ফরিদপুর জেলা) থেকে বিপুল সংখ্যক স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়। এসব স্বর্ণমুদ্রা থেকে ধারণা করা যায় যে, শ্যামচার দেবের পরেও এ অঞ্চলে বেশ কয়েকজন রাজার অসিত্মত্ব ছিল। এ সমসত্ম রাজাগণ সম্ভবত বঙ্গ শাসন করতেন। তারা শ্যামচার দেবের প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের শেষ সময়কার রাজা ছিলেন। ইতিহাসে তাদের সম্পর্কে স্পষ্ট এবং বিসত্মারিত ধারণা পাওয়া যায় নি। তবে এই রাজাগণের দ্বারা প্রদত্ত ছয়টি অনুদান থেকে প্রাদেশিক প্রশাসন সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়। এগুলো প্রমাণ করে যে, বঙ্গদেশে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থা ছিল যা জনগণের জন্য শামিত্ম ও সমৃদ্ধি নিয়ে এসেছিল।

খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের শেষ ভাগে চালুক্যের নৃপতি কীর্তিবর্মন (৫৬৭-৫৯৭ খ্রিঃ) বঙ্গ রাজ্য আক্রমণ করেন। মূলত কীর্তিবর্মনের আক্রমণের মধ্য দিয়েই শ্যামচারদেবের উত্তরাধিকারীদের শাসনের অবসান ঘটে। কীর্তিবর্মন বঙ্গ বিজয়েরও দাবি করেন। যদিও তার সফলতার প্রকৃতি এবং ব্যাপ্তি সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি তবুও একথা বলা যায় যে, তার আক্রমণের মধ্য দিয়েই ‘বঙ্গ’ রাজ্যের পতনের সূত্রপাত হয়।

 

খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের সূচনালগ্নে বর্তমান যশোর জেলা খুব সম্ভবত গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক (৬০৬-৬৩৭/৩৮ খ্রিঃ) এর অধীনে আসে। শশাঙ্ক শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গকে একত্রিত করে একটি স্বাধীন রাজ্যেই প্রতিষ্ঠা করেন নি, তিনি সমগ্র দক্ষিণ বিহার ও উড়িষ্যাতেও তার প্রভাব বিসত্মার করেছিলেন। কিন্তু একথা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয় যে, দক্ষিণবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গও শশাঙ্কের সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। তবে পন্ডিতগণ এ অঞ্চলে ‘ভদ্র’ নামে অভিজাত একটি পরিবারের কথা বলেন, যারা এ অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন। ৩

 

রাজা হর্ষবর্ধন (৬০৬-৬৪৭ খ্রিঃ)

 

রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বর্তমান যশোর জেলা উত্তর ভারতের মহান হিন্দু রাজা হর্ষবর্ধনের (৬০৬-৬৪৭ খ্রিঃ) অধিকারে আসে। বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর বর্ণনায় এ তথ্য পাওয়া যায়। হিউয়েন সাঙ হর্ষবর্ধনের শাসনামলে ৬৩৮ মতামত্মরে ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশ পরিভ্রমণ করেন। তিনি ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে তার ভ্রমণ সম্পর্কিত মূল্যবান বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। হিউয়েন সাঙ বঙ্গীয় ব-দ্বীপের নিম্নাঞ্চলে দু’টি রাজ্যের অসিত্মত্বের কথা বলেন। এর একটি ছিল সমতট, অন্যটি তাম্রলিপি। সমতট রাজ্যের অন্য নাম ছিল বঙ্গ। বঙ্গ ছিল সমুদ্রতীরবর্তী নিম্নভূমি; যা ছিল শস্য, ফুল এবং ফলে সমৃদ্ধ। আই চিঙ নামক অন্য একজন চীনা পরিব্রাজকও এ অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। তিনিও তার বর্ণনায় সমতট রাজ্যের কথা বলেন। তখন সমতটের রাজা ছিল‘হো-লো-শি-পো-তা’ যার সংস্কৃত অর্থ হর্ষবর্ধন। ৪

 

ভদ্র রাজবংশ (খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধ)

 

হিউয়েন সাঙ এর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ব্রাহ্মণ রাজাদের একাংশ ভদ্র রাজবংশের অমত্মর্ভুক্ত ছিল। তারা খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধ পর্যমত্ম সমতট এবং খুব সম্ভবত বর্তমান যশোর জেলা শাসন করতেন। নালন্দার গোষ্ঠীপতি শিলাচন্দ্র এ অভিজাত পরিবারের বংশধর ছিলেন। কিন্তু এ রাজবংশের অসিত্মত্ব সম্পর্ক বিসত্মারিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। ৫

 

খড়গ রাজবংশ (খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের দ্বিতীয় অর্ধাংশ)

 

খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের শেষার্ধে খড়গ নামযুক্ত অপর একটি বৌদ্ধ রাজবংশের কথা জানা যায়। এ রাজবংশ সমতট এবং খুব সম্ভবত যশোর জেলাও শাসন করত। এ রাজবংশ খড়গ রাজবংশ নামে পরিচিত ছিল এবং এদের হাতেই ভদ্র রাজবংশের পতন হয়েছিল। ঢাকা জেলার আশরাফপুরে প্রাপ্ত তাম্রফলক থেকে এ রাজবংশের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। তাম্রফলকটিতে খড়গ রাজবংশের তিনজন বিশিষ্ট রাজার নাম পাওয়া যায়। তারা হলেন খড়গদায়ম, তার পুত্র জাতাখড়গ এবং জাতাখড়গ এর পুত্র দেবখড়গ। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ।৬

 

যশোবর্মন (৭২৫-৭৩৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি)

 

খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের শেষার্ধে এবং ৮ম শতকের প্রথমার্ধে এ বঙ্গদেশ বিদেশী আগ্রাসনের শিকার হয়। গৌড় এবং মগধ রাজাদের ন্যায় বঙ্গের খড়গ শাসকদেরও এ আগ্রসনের কবলে পড়তে হয়েছিল। খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে কনৌজ অধিপতি যশোবর্মনের আগ্রাসন বেশ উলে­খযোগ্য। ৭২৫ থেকে ৭৩৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি কোন সময়ে যশোবর্মনের হাতে গৌড় রাজ্যের পরাজয় ও পতন ঘটে। গৌড় বিজয়ের পর বঙ্গ এবং বর্তমান বঙ্গদেশের সিংহভাগ তার দখলে আসে। কিন্তু তার শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি এবং এ শাসনের ধরণ সম্পর্কেও বিসত্মারিত তথ্য পাওয়া যায় নি।৭

 

পাল রাজবংশ (৭৮১-১০৮০ খ্রিঃ)

 

খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের মাঝামাঝি সময়ে পালগণ উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। খুব সম্ভবত পাল রাজবংশের দ্বিতীয় শাসক ধর্মপালের (৭৮১-৮২১ খ্রিঃ) শাসনামলে বর্তমান যশোর জেলার উপর তাদের কর্তৃত্ব কায়েম হয়। রাজা ধর্মপাল তার পিতার নিকট থেকে একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন। কিন্তু তার পরাক্রম ও কূটনীতি এবং সেই সাথে ভাগ্যের পরশ তাকে ভারতবর্ষের উত্তরাংশে একট সুবিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছিল। তিনিই পাল রাজাগণের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যিনি ‘পরমেশ্বর’ এবং ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধিতে ভূষিত হন। তিনিও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী এবং পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। রাজা ধর্মপাল ৭৮১ থেকে ৮২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যমত্ম দীর্ঘসময় শাসন করেছিলেন এবং তার শাসনামলে বর্তমান যশোর জেলার উপরও পালদের কর্তৃত্ব বজায় ছিল।

ধর্মপালের পর তার পুত্র দেবপাল (৮২১-৮৬১ খ্রিঃ) সিংহাসনে আরোহণ করেন। দেবপালও তার পিতার ন্যায় অত্যমত্ম যোগ্যতাসম্পন্ন রাজা ছিলেন। তিনি তার প্রজ্ঞা ও পরাক্রমের সাহায্যে কেবলমাত্র তার পিতার সাম্রাজ্য টিকিয়েই রাখেননি বরং তার আমলে পাল সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ বিসত্মার সাধিত হয়েছিল। ধর্মপালের ন্যায় দেবপালও দীর্ঘ সময় পর্যমত্ম শাসন করেন এবং যশোর জেলার উপরও তার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বজায় ছিল। তিনিও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে তিনি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। দেবপালের পর পাল রাজবংশের অন্য রাজাগণ হলেন রাজা প্রথম সুরপাল (৮৬১-৮৬৬ খ্রীঃ)। প্রথম সুরপাল বিগ্রহপাল নামেও পরিচিত ছিল। তার পরবর্তী রাজাগণ হলেন নারায়ণপাল (৮৬৬-৯২০ খ্রিঃ), রাজপাল (৯২০-৯৫২ খ্রিঃ), দ্বিতীয় গোপাল (৯৫২-৯৬৯ খ্রিঃ) এবং দ্বিতীয় বিগ্রহপাল (৯৬৯-৯৯৫ খ্রিঃ)। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন দুর্বল শাসক। তাদের শাসনামলে বিদেশী আগ্রাসনের কারণে সুবিশাল পাল সাম্রাজ্য ক্রমশ ছোট হতে থাকে। খ্রিস্টীয় দশম শতকের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে গন্ধ্ররা একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা পাল রাজাদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল। এমনকি পাল সাম্রাজ্যের ভিতরেই উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গে কামবোজা শাসকগণ নিজেদের স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করে। ফলশ্রম্নতিতে রাজা প্রথম মহীপালের সিংহাসনে আরোহণের পূর্ব পর্যমত্ম পাল শাসন আংগা এবং মগধ এ সীমিত হয়ে পড়ে। রাজা প্রথম মহীপালের (৯৯৫-১০৪৩ খ্রিঃ) সিংহাসনে আরোহণের সাথে সাথে ক্ষয়িষ্ণু পাল সাম্রাজ্যের সুদিন ফিরে আসতে শুরম্ন করে। তিনি সিংহাসনে আসীন হয়ে দেখতে পান পাল সাম্রাজ্য মূলত দক্ষিণ বিহার পর্যমত্ম সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তিনি সফলতার সাথে তার শত্রম্নদের নিধন করেন এবং কামবোজা শাসকদের কাছ থেকে উত্তর রাধা ও উত্তরবঙ্গ পুনরম্নদ্ধার করেন। প্রথম মহীপাল তার শাসনামলে উত্তর বিহার পর্যমত্ম পাল কর্তৃত্ব বিসত্মার করতে সফল হয়েছিলেন ফলে পাল সাম্রাজ্য পুনঃ প্রতিষ্ঠা করার কৃতিত্ব অবশ্যই তাকে দেয়া যায়। উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এ সময় যশোর জেলার উপরও পাল কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজা প্রথম মহীপালের পরবর্তী উত্তরাধিকারীগণ হলেন ন্যায় পাল (১০৪৩-১০৫৮ খ্রিঃ) এবং তৃতীয় বিগ্রহপাল (১০৫৮-১০৭৪ খ্রিঃ) তাদের শাসনামলে কালাচুরি’র নৃপতি লক্ষীকর্ণ বঙ্গদেশের এ অংশে বারবার অভিযান চালান। লক্ষীকর্ণের নেতৃত্বে সংগঠিত ক্রমাগত বিদেশী আগ্রসন পাল সাম্রাজ্যের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল। পাল রাজাগণ এসময় কেবলমাত্র পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তরবঙ্গের কর্তৃত্বই হারান নি, বরং মগধের এর উপরও তাদের কর্তৃত্ব ক্রমশ কমে আসতে শুরম্ন করে। তৃতীয় বিগ্রহপালের পুত্র ছিলেন দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭৫-১০৮০ খ্রিঃ)। দ্বিতীয় মহীপাল তার শাসনামলের প্রথমদিকে যশোর জেলার উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তীতে এ অঞ্চল বর্মনদের দখলে চলে যায়। উত্তবঙ্গের কৈর্বত্র বিপ­বের সুযোগে এ অঞ্চল বর্মনদের দখলে চলে যায় এবং ১০৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে তারা স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।৮

 

বর্মন শাসনামল

 

খুব সম্ভবত বঙ্গে কালাচুরি কর্ণের আগ্রাসনের সময়ই বর্মনদের আগমন ঘটে। বর্মনরা আগ্রাসনের সময় লক্ষীকর্ণকে সহযোগিতা করে এবং এদেশে থেকে যায়। পরবর্তীতে সুবিধামত সময়ে তারা নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এ রাজবংশের প্রসিদ্ধ শাসকগণ হলেন ভজরাবর্মণ, জাতবর্মন, হরিবর্মন, সমলবর্মন এবং ভোজবর্মন। বর্মনরা সনাতন বেদ এর অনুসারী ছিলেন। পরবর্তীতে তারা ‘সেন’ নামক আর একটি ব্রাহ্মণ সনাতন রাজবংশ দ্বারা উৎখাত হন।৯

 

সেন রাজবংশ(১১৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে খ্রিস্ট্রীয় ১৩ শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত)

 

রাজা বিজয়সেনের সময় বঙ্গদেশের এ অংশে এবং যশোর জেলার উপর সেন রাজবংশের শাসনের সূত্রপাত হয়। রাজা বিজয়সেন সেন রাজবংশের তৃতীয় রাজা ছিলেন (১০৯৭-১১৬০ খ্রিঃ)। সুবিশাল সেন সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রসত্মর তার হাতেই রচিত হয়েছিল। তিনি প্রায় সমগ্র বঙ্গদেশ জয় করেছিলেন। তবে বর্মন শাসকদের কাছ থেকে তার পূর্ববঙ্গ(সমতট) বিজয়ের সঠিক সময় সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত তিনি তার শাসনামলের শেষ সময়ে যশোর জেলার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার উত্তরসূরি বল­vল সেন (১১৬০-১১৭৮ খ্রিঃ) এবং লক্ষণসেন (১১৭৮-১২০৬ খ্রিঃ) ও এ জেলার উপর তাদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। লক্ষণসেনের শাসনামলেই ১২০৪ খ্রিঃ বঙ্গদেশে বিখ্যাত মুসলিম আগ্রাসনের সূত্রপাত ঘটে। শিহাবুদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরীর সেনাপতি মালিক ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ-বিন-বখতিয়ার-খিলজী এ সময় বঙ্গদেশ আক্রমন করেন। যখন বখতিয়ার খিলজী তার সেনাবাহিনী নিয়ে লক্ষণসেনের রাজধানী নদীয়ায় পৌঁছেন তখন রাজা লক্ষণসেন তার দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। মুসলিম সেনাবাহিনীর আগমনের সংবাদ শুনে তিনি নগ্নপদে তার রাজধানী হতে নৌকাযোগে বিক্রমপুরে পালিয়ে যান। ১২০৬ খ্রিঃ তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যমত্ম সময় তিনি সেখানে শাসনকার্য পরিচালনা করেন।১০

 

মুসলমান যুগ

 

১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজীর নদীয়া বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয়। কিন্তু মুসলিম সাম্রাজ্য তখনো পর্যমত্ম লক্ষণাবর্তীর চারপাশে কিছু সংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখন্ডে সীমাবদ্ধ ছিল। সুতরাং কেবলমাত্র নদীয়া বিজয়ের সাথে সাথেই যশোর জেলা লক্ষণাবর্তীর মুসলমান শাসকদের অধীনে আসেনি। সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইত্তয়াজ খিলজি-ই (১২১৩-১২২৭) হচ্ছেন লক্ষণাবর্তীর প্রথম শাসক যিনি দক্ষিণ এবং পূর্বে মুসলিম সাম্রাজ্য বিসত্মারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু তার শাসনামলেও যশোর জেলা লক্ষণাবর্তীর অমত্মর্ভুক্ত হয়নি। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শেষার্ধে সুলতান মুঘিসুদ্দিন তুঘরালের (১২৬৮-১২৮১) শাসনামলে এ জেলা লক্ষণাবর্তী রাজ্যের অধীনে আসে। স্যার জে.এন. সরকারের প্রদত্ত বক্তব্য থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। তিনি তার  গ্রন্থে বলেন,

 

"The power of the Seans was on the verge of extinction in the second half of the thirtenth century on account of Muslim attacks from the west... the Muslim possessions in Bengal included at least some portions of East Bengal (Bangladesh).... [Source : Sir J.N. Sarker; History of Bengal, Voll-II, Page-57].

 

সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবন (১২৬৬-১২৮৭ খ্রিঃ) এর শাসনামলে যশোর জেলার উপর দিল­xর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। লক্ষণাবর্তী রাজ্যের গভর্ণর সুলতান মুঘিসুদ্দিন তুঘরাল ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যমত্ম এ জেলা শাসন করেন। তিনি ছিলেন সর্বশেষ এবং সবচেয়ে মহান রাজা তিনি সামান্য ক্রীতদাস থেকে বাংলার সার্বভৌম ক্ষমতার আসনে আসীন হয়েছিলেন। কিন্তু তার জীবনের করম্নণ পরিণতি ঘটে। কারণ তিনি দিল­xর শাসকবর্গের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। লক্ষণাবর্তী রাজ্যের উপর তার স্বাধীন শাসন খুব স্বল্প সময় স্থায়ী হয়েছিল। সুলতান মুঘিসুদ্দিন তুঘরল এর মৃত্যুর পর সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবন এর পুত্র শাহজাদা নাসিরম্নদ্দিন মুহাম্মদ বুঘরা খান লক্ষণাবর্তীর গভর্ণর নিযুক্ত হন। তিনি ছয় বৎসর এ রাজ্য শাসন করেন। তার  শাসনামল ছিল ১২৮১ থেকে ১২৮৭ খ্রিঃ পর্যমত্ম। ১২৮৭ খ্রিঃ তার পিতার মৃত্যুর পর তিনি সুলতান নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ উপাধি লাভ করেন। এ সময় থেকেই লক্ষণাবর্তী রাজ্যের স্বাধীন স্বত্তা দিল­xর সালতানাতের স্বীকৃতি পেতে শুরম্ন করে। সেসময় থেকে ১২২৪ খ্রিঃ পর্যমত্ম যশোর জেলা লক্ষণাবর্তীর শাসকদের অধীনে ছিল। ১৩২৪ খ্রিঃ সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক লক্ষণাবর্তীকে তার সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত করেন এবং স্বাভাবিক কারণেই যশোর জেলা পুণরায় দিল­xর সালতানাতের এর অধীনস্থ হয়।১১

 

ইলিয়াসশাহী শাসন (১৩৪২-১৪১৪ খ্রিঃ এবং ১৪৪২-১৪৮৬ খ্রিঃ)

 

মুহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বের শেষ সময়ে রাজ্যব্যাপী বিদ্রোহ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে তার কর্তৃত্ব ক্রমশ কমে আসতে শুরম্ন করে। এসময় সমগ্র লক্ষণাবর্তী রাজ্য তিন খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফখরম্নদ্দিন, ইলিয়াস এবং আলীশাহ পৃথক পৃথকভাবে পূর্ব, দক্ষিণ এবং পশ্চিম অংশ শাসন করতেন। পরবর্তীতে ১৩৪২ খ্রিঃ ইলিয়াস শাহ যখন লক্ষণাবর্তীর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন তখন যশোর জেলা পুনরায় লক্ষণাবর্তীর অধীনে চলে যায়। এভাবে লক্ষণাবর্তীর সিংহাসনে ইলিয়াস শাহের আরোহণের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। তিনি শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ উপাধি লাভ করেন। এটি ছিল হিজরি ৭৪৩ সন এবং ১৩৪২ খ্রিঃ এর ঘটনা।

 

সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সমগ্র মুসলিম বঙ্গকে একত্রিত করে একটি রাজতন্ত্রের অধীনে এনেছিলেন এবং ১৩৫৭ খ্রিঃ তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যমত্ম সময় এ কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। তার উত্তরসূরিগণ হলেন সিকান্দার শাহ (১৩৫৭-১৩৯২) গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৯২-১৪১০) সাইফুদ্দিন হামজাহ শাহ (১৪১০-১৪১১ খ্রিঃ) শিহাবুদ্দিন বায়েজিদ শাহ (১৪১২-১৪১৪) এবং আলাউদ্দিন ফিরোজশাহ (১৪১৪ থেকে রাজা গণেশের উত্থান পর্যমত্ম সময়)। এসময় যশোর জেলা লক্ষণাবর্তী রাজ্যের অংশ হিসেবে তাদের দখলে ছিল। ১৪৮৭ সালে ইলিয়াস শাহী বংশের পতন ঘটিয়ে দাস বংশ তাদের রাজত্ব শুরম্ন করে। দাস রাজাগণ ১৪৯৩ খ্রিঃ পর্যমত্ম এখানে তাদের অধিকার টিকিয়ে রাখেন। দাস বংশের পতনের পর যশোর সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এর শাসনাধীন চলে যায়। ১৫৩৮ খ্রিঃ পর্যমত্মত্ম হুসেন শাহী বংশ এ অঞ্চলে তাদের শাসনকাল বজায় রাখে।১২

 

সম্রাট শেরশাহ (১৫৩৯-১৫৪৫ খ্রিঃ)

 

পরবর্তীতে গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ এর শাসনামলে দিল­xর প্রসিদ্ধ পাঠান সম্রাট শেরশাহ (১৫৩৯-১৫৪৫) বঙ্গদেশ দখল করলে যশোর তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। ১৫৪৫ খ্রিঃ শেরশাহ এর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরি ইসলাম শাহ ১৫৫৩ সাল পর্যমত্ম এ জেলার উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখেন। এ রাজবংশের পর যশোর জেলার কর্তৃত্ব চলে যায় কররানি পরিবারের হাতে। তাজ খান কররানি ছিলেন এ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর উলে­খযোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন সুলাইমান কররানি (১৫৬৫-১৫৭২) এবং দাউদ কররানি (১৫৭২-১৫৭৬) মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হবার পূর্ব পর্যমত্ম যশোর জেলার উপর তাদের কর্তৃত্ব কায়েম ছিল।১৩

 

মুঘল শাসনামল (১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রিঃ)

 

পাঠান রাজত্বের পর বিখ্যাত মোঘল রাজবংশ এ উপমহাদেশের বিশাল অঞ্চল জুড়ে তাদের স্মরণীয় শাসনকালের সূচনা করে। এ সময় সুবিখ্যাত মোঘল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) প্রথম এ অঞ্চলে ফৌজদার নিযুক্ত করে শাসন কার্য পরিচালনা করেন। বার ভূঁইয়াদের অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্য এ সময় এ জেলা শাসন করতেন। যশোরের প্রথম ফৌজদার ছিলেন ইনায়েত খাঁ। এরপর সরফরাজ খাঁ, নুরম্নল­vখাঁ পর্যায়ক্রমে যশোর এর ফৌজদার নিযুক্ত হয়ে আসেন। নবাবী শাসনামলে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ (১৭০৩-১৭২৬) এর শাসনামলে সীতারাম রায় নামক একজন স্থানীয় রাজা কর্তৃক যশোর জেলা শাসিত হত। সীতারাম ছিলেন উত্তর রাঢ় বংশীয় কায়সত্ম। তার পিতা উদয় নারায়ণ ভূষণার ফৌজদারের অধীনে একজন তহশিলদার ছিলেন। রাজা সীতারাম রায়ের রাজধানী ছিল মহম্মদপুর। রাজা সীতারাম রায় মুর্শিদকুলী খাঁ কে অমান্য করলে নবাব তার বিরম্নদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন। যুদ্ধে সীতারাম পরাজিত হন। সীতারামের পতনের পর যশোর জেলা কয়েকটি জমিদারীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। নাটোর এর জমিদার জেলার পূর্বাংশ, চাঁচড়ার জমিদার জেলার দক্ষিণাংশ এবং নলডাঙ্গার জমিদার জেলার উত্তরাংশ তাদের জমিদারির অমত্মর্ভুক্ত করে নেয়। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে গৌড়ের শাসনকর্তা দাউদের একজন বিশ্বসত্ম সহযোগী শ্রীহরি ১৫৭৪ সালে যশোর এর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং স্বাধীন যশোর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাসে এই শ্রীহরিই মহারাজ বিক্রমাদিত্য নামে পরিচিত। বিক্রমাদিত্য গৌড়ের রাজা দাউদ কর্তৃক প্রদত্ত উপাধি। বিক্রমাদিত্যের রাজধানী ছিল ঈশ্বরপুর এবং ত্রেকাটিয়াতে। ১৫৮৩ খ্রীস্টাব্দে বিক্রমাদিত্য মৃত্যুবরণ করেন। বিক্রমাদিত্যের শাসনকালে তার বিশ্বসত্ম সহযোগী ও জ্ঞাতি ভ্রাতা বসমত্মরায়ই যশোরের প্রকৃত শাসক ছিলেন। গৌড় থেকে নিয়ে আসা অঢেল ধন-সম্পদ দ্বারা বসমত্মরায় যশোরকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করে গড়ে তোলেন। বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর কয়েক বছর পর ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে তার পুত্র প্রতাপাদিত্যকে বসমত্মরায় যশোরের রাজা বলে ঘোষণা করেন। প্রতাপাদিত্যের প্রকৃত নাম ছিল গোপীনাথ। ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি গৌড়ে জন্মগ্রহণ করেন। প্রতাপাদিত্য ছিল তার প্রাপ্ত উপাধি। সুন্দরবন অঞ্চলের ধুমঘাট ছিল তার রাজধানী। ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে দিল­xর সম্রাট নাসির শাহ অথবা মাসুদ শাহ খাজা জাহান বা খাঁন জাহান আলী নামক একজন সুফি দরবেশকে বঙ্গদেশে প্রেরণ করেছিলেন। খাজা জাহান বা খাঁন জাহান আলী সম্রাট মামুদ শাহ কর্তৃক প্রদত্ত উপাধি। তাঁর প্রকৃত নাম উলুখ খাঁন। বঙ্গদেশে এসে খাঁন জাহান আলী যশোর অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেন। পরবর্তীকালে তিনি একজন বিখ্যাত ইসলামী সাধক ও ধর্ম প্রচারক হিসেবে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। যশোরের পয়গ্রাম কসবা খাঁন জাহান আলীর রাজধানী ছিল।১৪

 

ব্রিটিশ শাসনামল (১৭৫৭-১৯৪৭ খ্রিঃ)

 

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার ক্ষমতা দখল করে। লর্ড কাইভ ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ উদ-দৌলাকে (১৭৫৬-১৭৫৭) পরাজিত করলে উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য অসত্মমিত হয়। শুরম্ন হয় ইংরেজ রাজত্ব। চলে বর্ণ বৈষম্যবাদী শাসন। কোম্পানী ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের নিকট থেকে বাংলার দেওয়ানী লাভ করে। ফলে যশোর জেলা কোম্পানীর রাজস্ব প্রশাসনের অধীনে চলে যায়। প্রায় দুইশত বৎসর ইংরেজগণ উপমহাদেশে তাদের শোষণ ও নির্যাতনের শাসনকাল অব্যাহত রাখে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরম্ন করে পরবর্তী কালের নীল বিদ্রোহ, কৃষক সংগ্রাম ও স্বদেশী আন্দোলনসহ অসংখ্য বিপ­ব একের পর এক ইংরেজদের বিরম্নদ্ধে সংঘটিত হতে থাকে।১৫

 

পাকিস্তান আমল ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় (১৯৪৭-১৯৭১ খ্রিঃ)

 

অতপর ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা এদেশ থেকে বিতাড়িত হয়। ইংরেজরা উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হবার আগে এদেশে তাদের কৌশলের বীজ বুনে যায়। ফলে সৃষ্টি হয় দেশ বিভাগের। উপমহাদেশে জন্মলাভ করে দু’টি দেশ- ভারত ও পাকিসত্মান। যশোরকে তদানিমত্মন পূর্ব পাকিসত্মানের অমত্মর্ভুক্ত করা হয়। পাকিসত্মান রাষ্ট্রের দু’টি অংশ ছিল- পূর্ব পাকিসত্মান (বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিসত্মান)। পশ্চিম পাকিসত্মানীরা দীর্ঘ দুই যুগ এ অঞ্চলকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করে এবং আগ্রাসী রাজত্বের নজিরবিহীন শোষণ ও অপশাসন চালিয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের ফলে অবিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলকে করা হয় পাকিসত্মানের অংশ এবং পশ্চিমাঞ্চলকে করা হয় ভারতের। এর মধ্যে সীমানারেখা নির্ধারণের ফলে যশোর জেলার ভৌগোলিক অবস্থানের পরিবর্তন সাধিত হয়। এসময় যশোরের বনগ্রাম মহকুমাকে পুনরায় ভারতের সাথে সংযুক্ত করা হয়। ১৯৭১ সালে, বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালিরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করে। তাই ১৫৭৪ খ্রিঃ থেকে ১৯৮৪ খ্রিঃ পর্যমত্ম অব্যাহতভাবে চলতে থাকে যশোর এর গঠন ও পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়া। ১৯৬০ সালে জেলার মাগুরা মহুকুমার মহম্মদপুর থানার অংশ এবং নড়াইলের আলফাডাংগা থানাকে ফরিদপুর জেলার সাথে যুক্ত করা হয়। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রশাসনিক উন্নয়নকল্পে আজকের যশোরকে ভেঙ্গে পুনর্গঠন করেছে। ফলে জেলার চার মহকুমা নড়াইল, মাগুরা, ঝিনাইদহ এবং সদর স্বতন্ত্র চারটি জেলায় রূপামত্মরিত হয়েছে।

No comments

Theme images by loops7. Powered by Blogger.